লিখক: নাছের উদ্দিন মিয়াজী, অ্যাডভোকেট, জজ কোর্ট, ফেনী
‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা-২০০৯’-এর সংশোধন করেছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে এখন থেকে অনলাইনেও বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন করা যাবে। তবে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিও বহাল থাকবে।
সম্প্রতি বিধিমালা সংশোধন করে সম্প্রতি আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
সংশোধিত বিধিমালায় বলা হয়েছে, নিকাহ ও তালাক নিবন্ধন ম্যানুয়ালি বা অনলাইন পদ্ধতিতে সম্পাদন করা যাবে।
এতে বলা হয়, অনলাইন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যমে বা সরকার থেকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ফি পরিশোধ করা যাবে।
অনলাইন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ফরম ‘ঘ’-তে যেসব ব্যক্তির স্বাক্ষর প্রয়োজন তারা সরকার থেকে নির্ধারিত পদ্ধতিতে ডিজিটাল মাধ্যমে বা সরাসরি স্বাক্ষর এবং নিরক্ষর ব্যক্তির ক্ষেত্রে টিপসই দেবেন বলেও বিধিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনলাইন পদ্ধতিতে বিয়ে ও তালাক নিবন্ধন করার বিষয়ে আইনি জটিলতা দূর করতে সংশোধনী আনা হয়েছে। অনলাইন পদ্ধতি চালু করতে এখন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা নিয়ে আসছে:
- অনলাইন নিবন্ধন: এখন থেকে, বিবাহ এবং তালাকের নিবন্ধন অনলাইনে করা যাবে, যার ফলে সরকারি অফিসে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার প্রয়োজন পড়বে না। অনলাইনে ফি পরিশোধও করা যাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে।
- বাল্যবিবাহ এবং বহুবিবাহের প্রতিরোধ: এনআইডি বা জন্মসনদ যাচাই করে বয়স যাচাই এবং পূর্ববর্তী বিবাহের তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ কমানো সম্ভব হবে।
- নারীর আইনি অধিকার নিশ্চিতকরণ: বৈধ নিবন্ধনের মাধ্যমে নারীরা তাদের সম্পত্তির অধিকার, উত্তরাধিকার এবং তালাকের পরে আইনি সুরক্ষা পাবে।
- প্রতারণার সুযোগ হ্রাস: ডিজিটাল রেকর্ড ব্যবহারের ফলে বিবাহিত ব্যক্তিরা নতুন বিয়ে গোপন রাখতে পারবেন না, যা সামাজিক জটিলতা এবং প্রতারণার সম্ভাবনা কমাবে।
- দুর্নীতির সীমাবদ্ধতা: অনলাইন নিবন্ধনে ফি এবং তথ্য সঠিকভাবে প্রদর্শিত হবে, যার ফলে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুযোগ কমে যাবে এবং দুর্নীতি হ্রাস পাবে।
- তথ্য সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধার: অনলাইনে নিবন্ধন করার ফলে বিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত তথ্য সহজেই সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হবে, যা ভবিষ্যতে আইনি বা প্রশাসনিক প্রয়োজনে সহায়ক হতে পারে।
- ডিজিটাল রূপান্তরে সহায়তা: এই আইনটি ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।
- প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা: অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া অধিক স্বচ্ছ হবে, যাতে নাগরিকরা সহজেই তথ্য যাচাই করতে পারবেন এবং কোন ধরনের দুর্নীতির আশঙ্কা থাকবে না।
- আইনি সুরক্ষা বৃদ্ধি: তালাক নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হওয়ায়, নাগরিকরা আইনি সুরক্ষা ও অধিকার সহজে পেতে সক্ষম হবেন, বিশেষ করে নারীরা।
- স্বাক্ষরের সহজ ব্যবস্থা: অনলাইন নিবন্ধনের ক্ষেত্রে যেসব ব্যক্তির স্বাক্ষর প্রয়োজন, তারা ডিজিটাল পদ্ধতিতে বা সরাসরি স্বাক্ষর করতে পারবেন, যা প্রযুক্তির ব্যবহারে সহজ করবে। এছাড়াও, নিরক্ষর ব্যক্তিরা টিপসই দিয়ে নিবন্ধন সম্পন্ন করতে পারবেন, ফলে তাদের জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে।
এই আইনের অধীনে কিছু অসুবিধা হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে:
- ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব: অনেক নাগরিক, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত নন। তাদের জন্য অনলাইন নিবন্ধন পদ্ধতি কঠিন হতে পারে, যা ব্যবস্থার কার্যকারিতা সীমিত করতে পারে।
- কাজীদের প্রশিক্ষণের অভাব: অনেক কাজী এবং তাদের সহকর্মীরা এই ডিজিটাল প্রক্রিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। ফলে, সঠিকভাবে প্রক্রিয়া পরিচালনা করা এবং সেবা প্রদান করতে তাদের সমস্যা হতে পারে।
- সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি: যেহেতু সকল তথ্য অনলাইনে সংরক্ষিত হচ্ছে, তাই সাইবার হামলা বা তথ্য চুরির ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। এটি ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা ও সুরক্ষায় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা: অনলাইন নিবন্ধন সিস্টেমে কোনো প্রযুক্তিগত সমস্যা (যেমন সার্ভার ডাউন, ইন্টারনেট সমস্যা ইত্যাদি) হলে নাগরিকরা তাদের নিবন্ধন সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হতে পারেন। এর ফলে সময় এবং সুযোগ নষ্ট হতে পারে।
- প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা: পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল হয়ে যাওয়ার কারণে, যারা ইন্টারনেট বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য এই পদ্ধতি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এটি বিশেষভাবে দরিদ্র বা সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
- অতিরিক্ত খরচ: কিছু ক্ষেত্রে, অনলাইন নিবন্ধন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত পেমেন্ট সিস্টেম বা অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহারের খরচ নাগরিকদের জন্য একটি বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
- ভবিষ্যতের জন্য নিরাপত্তা: যদিও অনলাইন নিবন্ধন তথ্য সুরক্ষিত রাখতে ডিজিটাল সিগনেচার ও এনআইডি যাচাই ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও তথ্যের সঠিকতা ও সুরক্ষার ব্যাপারে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা না থাকলে ভুল বা জালিয়াতির সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
এই অসুবিধাগুলোর সমাধান করতে সরকারের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা, এবং সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন।
পরিশেষে, বাংলাদেশের বিয়ে ও তালাক নিবন্ধনের নতুন অনলাইন পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা নাগরিকদের জন্য সেবা প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে সহজ, দ্রুত এবং স্বচ্ছ করবে। এটি বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ, নারীর আইনি সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি কমাতে সহায়তা করবে। যদিও ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এবং সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি রয়েছে, তবে সঠিক প্রয়োগ এবং সরকারের সহায়তায় এই ব্যবস্থা আরও কার্যকরী হতে পারে। এটি বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।